ঠেকানো যাচ্ছে না সর্বনাশা ইয়াবা
কায়সার হামিদ মানিক, কক্সবাজার প্রতিনিধি:
মিয়ানমার থেকে মরণ নেশা ইয়াবার চোরাচালান কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। কক্সবাজার-টেকনাফের উপকূলের স্থল ও সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই আসছে একের পর এক বড় বড় ইয়াবার চালান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সড়ক পথে পাচারের পাশপাশি এখন ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে সাগরপথে। আর পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট সাগর ও সড়ক পথে সমান তালে ইয়াবা পাচার করছে। গত ৬ দিনে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা পৃথক অভিযান চালিয়ে শত কোটি টাকার অধিক ইয়াবাসহ জড়িতদের আটক করেছে। এর মধ্যে ১৬ এপ্রিলের ২০ লাখ ইয়াবা চালানটি ছিল দেশে ইয়াবার চালানের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ইয়াবা প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর জিরো টলারেন্স নীতি বলবৎ থাকলেও সাগর পথে ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা পাচার।
জানা গেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রামে ২০ লাখ ও টেকনাফ থেকে ১০ লক্ষ দুই বড় চালানের আটকে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ কেন্দ্রীক দেশের সর্ববৃহৎ একটি আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচার চক্রের সদস্য হাবীব মেম্বার, কালা জামাল, ওয়াহিদুর রহমান, ওয়াহিদুজ্জামান, সাইফুল করিম, জেট করিমের নাম উঠে এসেছে। ২০ লাখ ইয়াবার চালানসহ মাছ ধরার ট্রলার আটক হলেও গত ৪ মাসে মোট ৭৬ লাখ ইয়াবার ৪টি চালান এই চক্র খালাস করেছে বলে র্যা ব সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে চক্রটি গত ডিসেম্বর মাসে ১৬ লাখ এবং জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে তিন চালানের প্রতিটিতে ২০ লাখ করে আরও ৬০ লাখ ইয়াবা খালাস করে। চার দফা ইয়াবা পাচারে সক্ষম হলেও পঞ্চম দফায় গ্রেপ্তার হয় মোজাহার ।
আরও জানা গেছে, সম্প্রতি কক্সবাজারের কলাতলীর ইয়াবা ব্যবসায়ী মফিজ ও টেকনাফের নুর মোহাম্মদ বন্দুক যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র এলাকায় টহল বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং এ চক্রটি টেকনাফ থেকে গভীর সমুদ্র হয়ে বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী ও হাতিয়া উপকূলে ইয়াবার চালান নিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচারকারী টেকনাফের হাবীব, কালা জামাল, সাতকানিয়ার ওয়াহিদুর রহমান, কক্সবাজার শহরের ওয়াহিদুজ্জামান, টেকনাফের সাইফুল করিম, জেট করিম ও চট্টগ্রামের মোজাহার চক্রটি ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছে।
গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে তারা কয়েক বছর যাবৎ ঢাকার উত্তরা ও চট্টগ্রামের চাকতাইতে বিলাসবহুল জীবনযাপন ও লোক দেখানো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসবাস করছে। তবে সাগর পথে ইয়াবা পাচারের সময় টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় তাদের দেখা গেলেও পাচারের পরপরই টেকনাফ থেকে লাপাত্তা হয়ে যায়।
জানা যায়, ঢাকা থেকে চার জনের এ সিন্ডিকেট মাছ ধরার ট্রলারযোগে প্রতি সপ্তাহে কক্সবাজারের সমুদ্রপথে লক্ষ লক্ষ ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে নারায়নগঞ্জ, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী ও হাতিয়া উপকূলে। এসব চালান খালাস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকার গুলশান, বনানীসহ অভিজাত পাড়ায়। আর সাগর পথে ইয়াবা পাচারে জড়িত হাবীব-জামাল-ওয়াহিদ মাফিয়া চক্রের খোঁজে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ইয়াবা জগতের মাফিয়া খ্যাত আলো ও রশীদ কুলু ধরা পড়েছিল র্যা বের হাতে। তার থেকেই প্রথম জানাজানি হয় ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে কক্সবাজার উপকূলের সমুদ্রপথ ব্যবহারের কথা। সাগর পথে ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে এ সিন্ডিকেট সাগরে যাওয়া গরু, গাছ ও মাছ ধরার ট্রলার এবং মাঝিমাল্লাদের ব্যবহার করছে।
গত ১৬ এপ্রিল রোববার ভোর ৫টায় বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ ইয়াবা ও আট সহযোগীসহ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৭) হাতে ধরা পড়েছেন চট্টগ্রামের আনোয়ারার শীর্ষস্থানীয় ইয়াবা পাচারকারী মোজাহার। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এটি র্যাবের হাতে ধরা পড়া দ্বিতীয় বৃহত্তম ইয়াবার চালান বলে জানা গেছে। র্যাব-৭ এফ বি মোহসেন আউলিয়া নামের একটি ট্রলার থেকে মোজাহার বাহিনীকে গ্রেপ্তার করে। ট্রলারটি ইয়াবার চালান নিয়ে সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে হাতিয়া হয়ে আনোয়ারায় আসছিল। অভিযানে ট্রলার তল্লাশি করে ২০ লাখ ইয়াবা পাওয়া যায়। র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন।
আনোয়ারায় বঙ্গোপসাগরে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন নগরের পাঁচলাইশ থানার সুগন্ধা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ও মোজাহার সিন্ডিকেটের প্রধান মোঃ মোজাহার (৫৫), কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মোঃ মকতুল হোসেন (৫০), আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামের মোঃ নূর (৩৭), মোঃ হেলাল (২১), মোঃ আব্দুল খালেদ (৬০), জানে আলম (৩২), মোঃ লোকমান (৫৯), মোঃ নূরুল মোস্তফা (২৬) ও নোয়াখালী সদর থানার মোঃ এনায়েত উল্লাহ (৭২)।
উদ্ধারকৃত ইয়াবা পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি র্যাবের এ অভিযানকে স্বাগত জানান এবং ইয়াবা পাচার বন্ধে নির্দেশনা দেন।
র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ জানান, র্যাব-৭ আসামীদের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দীর্ঘ নজরদারির পর তাদের গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়।র্যাব জানতে পারে, মিয়ানমার এবং এ দেশীয় পাচারকারীরা আনোয়ারা উপজেলার গহিরা ভিত্তিক ইয়াবা পাচারকারী চক্র তৈরি করে। তারা মাছের আড়ালে ইয়াবা নিয়ে আসে। মিয়ানমার থেকে এসব ইয়াবা চালান সাগরেই ট্রলার বদল হয়।
লেঃ কর্নেল মিফতা বলেন, র্যাব চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ইয়াবা বড় কয়েকটি চালান আটকের পর পাচারকারীরা এখন রুট পরিবর্তন করে বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, হাতিয়াসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল দিয়ে ইয়াবা পাচার করছে। এরই মধ্যে র্যাব জানতে পারে, মোজাহের ফিশিং ট্রলারের অন্তরালে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা নিয়ে মিয়ানমার থেকে হাতিয়ার উদ্দেশে রওনা করেছে। পরে সেখান থেকে আরেকটি ট্রলারযোগে ইয়াবাগুলো আনোয়ারার গহিরার দিকে আনা হচ্ছে। এমন তথ্য পাওয়ার পরই র্যাব অভিযান শুরু করে এবং ট্রলার থেকে ইয়াবাসহ আসামিদের ধরতে সক্ষম হয়। উদ্ধারকৃত ইয়াবার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে র্যাব দাবি করে।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য উল্লেখ করে র্যাব কর্মকর্তারা জানান, মিয়ানমারের নাগরিক শুকুর, লাল মিয়া ও মগ ওরফে সেনসুর কাছ থেকে তারা ইয়াবা সংগ্রহ করে। এই সিন্ডিকেট গত ডিসেম্বর মাসে ১৬ লাখ, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ২০ লাখ করে ৬০ লাখসহ মোট ৭৬ লাখ ইয়াবা পাচার করেছে।
আসামিরা র্যাবকে জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে আনোয়ারার সবুর, কালা মনু, ফয়েজ, সেলিম, জাহাঙ্গীর, জালাল, লেদু ও মনুসহ আরো অনেকে রয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গত ৭ এপ্রিল আসামিরা মিয়ানমারের নাগরিক মগ ওরফে সেনসুসহ এফ বি মোহসেন আউলিয়া ট্রলারে মাছ ধরার ছদ্মাবরণে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট থেকে রওনা করে। ট্রলারটি কর্ণফুলী নদী হয়ে কুতুবদিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ, শাহরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিনসের পশ্চিম মিয়ানমারের পচাখালীর বাতির বাইরে একটি তেলবাহী জাহাজ থেকে ইয়াবার বস্তা সংগ্রহ করে। পরে সেখান থেকে আনোয়ারার গহিরা আসার পথে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়।
অন্যদিকে কক্সবাজারের টেকনাফে প্রায় ১০ লাখ পিসের ইয়াবার একটি বড় চালান উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।তবে কাউকে আটক করতে পারেনি। রবিবার সকালের দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের খারিয়াখালী এলাকা থেকে এ পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য ২৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এ অভিযান নিয়ে রবিবার দুপুরে টেকনাফের বিজিবি-২ ব্যাটালিয়ন দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি অধিনায়ক লেঃ কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ বলেন, ভোরে তাঁর নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে হারিয়াখালী সাগরে বিজিবির একটি টহল দল ওতপেতে থাকে। এ সময় তিন-চারজন লোক মাথায় বস্তা নিয়ে সাগর পাড় থেকে উঠে আসছিল। বিজিবি সদস্যরা তাৎক্ষনিক পাচারকারীদের চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁদের (বিজিবি) উপস্থিতি দেখতে পেয়ে পাচারকারীরা বস্তাগুলো ফেলে সাগরে অবস্থিত বোট দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে বিজিবি সদস্যরা বস্তাগুলো উদ্ধারের পর গণনা করে তাতে ৯ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা পান। জব্দ হওয়া এই ইয়াবাগুলো বিজিবির টেকনাফ সদর ব্যাটালিয়নে জমা রাখা হয়েছে, যা পরে ধ্বংস করা হয়।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাই